ভাবুন তো, একটা সিনেমা, যেটা ভারতীয় চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতাকে পুরো বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারতো। কিন্তু সেই সিনেমা টা আজও একটা আক্ষেপ হয়ে রয়ে গেছে। আজকে আমরা আলোচনা করবো বাংলার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা, সত্যজিৎ রায় এবং তার প্রজেক্ট “The Alien” নিয়ে। কাজেই, হারানো ইতিহাস, সম্ভাবনা, আর এক উজ্জ্বল প্রতিভার স্বপ্নের রাজ্যে ডুব দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যান।
পর্ব ১: সত্যজিৎ রায় কে ছিলেন?
চলুন শুরুতে জানা-যাক, কে এই সত্যজিৎ রায়?
১৯২১ সালে কলকাতায় জন্মানো সত্যজিৎ বেঙ্গলের বিখ্যাত রায় পরিবার থেকে এসেছেন। তার সৃজনশীলতার শিকড় ছিল তার বাবা সুকুমার রায়ের মধ্যে।
সুকুমার রায়, যার লিখা মজার সব ছড়া তাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে, তারই লিখা অবোল তাবোল ছড়াটি আমরা কখনো না কখনো পড়েছি।
অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়, যিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে গল্পকার, গ্রাফিক ডিজাইনার, আর সুরকার।
তার তৈরি, গুপী গাইন বাঘা বাইন, চারুলতা, এবং অপু ট্রিলজি এসব মাস্টারপিস গুলো, আজো মানুষের মনে গেথে রয়েছে। তার সৃষ্টি গুলো ছিল মানুষের জীবন, অনুভূতি এবং বাস্তবতা কে সৃজনশীলতার মাধ্যমে তুলে ধরার এক অদ্ভুত দক্ষ উদাহরণ।
পর্ব ২: The Alien এর কল্পনা
এবার চলুন কথা বলি The Alien নিয়ে। এটি এমন একটি গল্প, যেটা ভারতীয় সিনেমাকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো। The Alien এর গল্পটি সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প বঙ্কুবাবুর বন্ধু থেকে নেওয়া। গল্পে, একটা এলিয়েন এক গ্রামে এসে এক বালকের সাথে বন্ধুত্ব করে, আর তার যাদুকরী ক্ষমতা দেখায়। এইটুকু শোনার পর কি কিছু মনে পড়ছে? চলুন একটু মনে করা যাক! ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় স্পিলবার্গের বিখ্যাত মুভি E.T.। যেখানে দেখানো হয়, একটি এলিয়েন পৃথিবীতে এসে আটকা পড়ে, পরবর্তীতে এলিয়েন এর সাথে এক গ্রামের ছেলের বন্ধুত্ব হয়। মিল খুঁজে পাচ্ছেন? সময়ের চাকা ঘুরিয়ে চলুন জানা যাক বিশ্বাস ঘাতকতা, আর রহস্যে ভরা এক বিতর্কিত কাহিনী।
পর্ব ৩: হলিউড কানেকশন
১৯৬০-এর দশকে যখন সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা আর সৃজনশীলতার চর্চা গোটা বিশ্ব জুড়ে হচ্ছিলো। তখন হলিউডে বিখ্যাত প্রযোজক মাইক উইলসনের নজর পড়ে বঙ্কু বাবুর বন্ধু গল্পটির উপর। উইলসন তখন বঙ্কু বাবুর বন্ধু গল্পটিকে একটি হলিউড মুভিতে রূপান্তর করার প্রস্তাব নিয়ে কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের বাস ভবনে হাজির হন। সত্যজিৎ রায় তার এই প্রস্তাবে রাজি হয় এবং লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে তিনি পুরো মুভির স্ক্রিপ্ট এবং দৃশ্য গুলোর স্কেচ তৈরি করেন, এবং সেই প্রজেক্টের নাম দেন The Alien। সব কিছু ঠিক ভাবেই চলছিলো, Colombia Pictures এর মতো বড় কোম্পানিটি তৈরী ছিলো প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের জন্য,এমনকি সেই সময় শুনা যাচ্ছিলো তৎকালীন বিখ্যাত অভিনেতা, Marlon Brando এই মুভির প্রধান চরিত্র হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় এখানেই। মাইক উইলসন, যিনি রায়কে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনিই The Alien এর কপিরাইট নিজের নামে ফাইল করেন। রায় যখন বুঝতে পারেন যে তাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি প্রজেক্টটি ছেড়ে দিয়ে আবার কলকাতা চলে আসেন, কিন্তু Columbia Pictures চাচ্ছিলো মুভিটি সত্যজিৎ রায়ের অধিনেই নির্মান হোক, কিন্তু জটিলতা বাড়তে থাকায় প্রজেক্টটি থেমে যায়। পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায় জানতে পারেন যে, তার তৈরি করা স্ক্রিপ্ট এবং স্কেচ গুলো Hollywood এর শতাধিক প্রযোজকের হাতে হাতে ঘুরছে! তখন তিনি বিষয়টিকে জানতে পেরে মর্মাহত হন। তার কিছু দিন পর মাইক উইলসন একটি চিঠির মাধ্যমে রায়কে জানান যে, তিনি The Alien এর সম্পূর্ণ কপিরাইট উইথড্র করছেন।
পর্ব ৪: স্পিলবার্গ বিতর্ক
এরপর ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় স্পিলবার্গের E.T. কিন্তু যারা The Alien এর গল্প জানতেন, তারা দুটি কাহিনীর অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। সত্যজিৎ রায় সরাসরি স্পিলবার্গকে দোষারোপ না করলেও বলেছিলেন, The Alien এবং E.T. এর মধ্যে অনেক বেশি মিল রয়েছে, যা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে সত্যজিৎ রায় সর্বদা কন্ট্রোভারর্সি অপছন্দ করতেন, তাই যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হলো এই বিষয়টির জন্য তিনি কোনো প্রকার মামলা করতে চান কিনা, তখন তিনি বলেন যে স্পিলবার্গ এই মুভিতে অসাধারণ কাজ করেছে, এবং সে নতুন, এখন এমন কিছু করলে তার ক্যারিয়ারে একটি কালো দাগ লেগে যাবে। তিনি আরো বলেন যে, “আমি যদি The Alien নির্মাণ করতাম, হয়তো সেটা স্পিলবার্গের E.T. এর মতো এতো সফলতা পেতো না, এই বিষয়টির জন্য আমাদের অবশ্যই তার কাজের প্রশংসা করা উচিত। বিপরীতে যখন স্পিলবার্গকে E.T. এবং The Alien এর মিল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি বলেন “যখন The Alien এর স্ক্রিপ্ট Hollywood এ ঘুরছিলো তখন আমি একজন স্কুল স্টুডেন্ট ছিলাম, এবং আমি সেই স্ক্রিপ্ট কখনো দেখিনি। তার এই কথা তখন ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করে, কেননা এটি কোনো প্রকার অজুহাত হতে পারে না, দুটি কাহিনির মধ্যে এত বেশি মিল নেহাতই কাকতালীয় হওয়া অসম্ভব।
পর্ব ৫: সত্যজিৎ রায়ের অর্জন
The Alien নির্মিত না হলেও সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা কখনো ম্লান হয়নি । তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছেন। তার সৃজনশীলতা আর অবদান সারা বিশ্বে সম্মানিত। ১৯৯২ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে অস্কার সম্মান অর্জন করেন। এছাড়াও, ভারত রত্ন সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। “The Alien” শুধু একটি অসমাপ্ত সিনেমার গল্প নয়। এটি আমাদের শেখায় সৃজনশীলতাকে রক্ষা করতে এবং আমাদের আইডিয়াগুলোর প্রতি যত্নবান হতে। সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন, কাজ সফল না হলেও, সেটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে। The Alien যদি নির্মিত হতো, তাহলে ভারতীয় সৃজনশীলতাকে বিশ্বজুড়ে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেত। তবে সত্যজিৎ রায়ের কাজ আমাদের দেখিয়েছে, প্রতিভা আর সৃষ্টিশীলতা কোনো বাধায় থামে না।
Tags:
Content