ভার্চুয়াল প্রোডাকশন: গ্রিন স্ক্রিনের পরবর্তী ধাপ

আমরা যখন এমন এক যুগে, যেখানে প্রযুক্তি প্রতিটি শিল্প ক্ষেত্রকে নতুন আকার দিচ্ছে। তখন ফিল্মেকিং এবং এন্টারটেইনমেন্ট জগৎ দাঁড়িয়ে আছে নতুন এক বিপ্লবের সামনে। ভার্চুয়াল প্রোডাকশন হচ্ছে সেই বিপ্লব, যা হলিউডে বিগত বছরগুলোতে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। কিন্তু এর মানে কি? কি এই ভার্চুয়াল প্রোডাকশন?

আপনি কি কখনও পর্দার পিছনের এমন কোনো দৃশ্য দেখেছেন? যেখানে অভিনেতারা এমন কোনো পরিবেশে নির্বিঘ্নে  অভিনয় করছেন, যেটি বাস্তব জগতে বিদ্যমান নেই? যদি কখনো এমন কোনো দৃশ্য দেখে আপনার মনে প্রশ্ন জেগে থাকে 'এটি কিভবে সম্ভব?' তাহলে অভিনন্দন,  আপনি এখন এই চমৎকার জাদুর পিছনের রহস্য আবিষ্কার করতে চলেছেন। লাইট, ক্যামেরা, ভার্চুয়াল অ্যাকশন।

ব্লকবাস্টার মুভি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সব ভিডিও গেম পর্যন্ত, এই সব গুলো কাল্পনিক গল্প গুলোকে বাস্তব করে তোলার উপায় "ভার্চুয়াল প্রডাকশন"। কিন্তু এটি শুধু ঝলমলে ভিজুয়াল ইফেক্টের কথা নয়, এটি একটি গেম চেঞ্জার, যা কন্টেন্ট তৈরির জগৎকে করে তুলবে আরো বৃহৎ এবং একি সাথে সৃজনশীলতা প্রকাশ, দক্ষতা প্রদর্শন এবং সম্ভাবনার অগণনিত পথ উন্মোচন করবে। আপনি একজন ফিল্মেকার, একজন প্রযুক্তি উৎসাহী, বা বিনোদন জগতের ভবিষ্যত নিয়ে যতই কৌতুহলী হন না কেনো, বিপ্লবের আজকের এই যাত্রা আপনাকে মোহিতো করবেই। তাহলে চলুন ভার্চুয়াল জগতের চমৎকার এই যাত্রা শুরু করা যাক।

ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের সংজ্ঞা এবং মূল ধারণা:

ভার্চুয়াল প্রোডাকশন হলো Filmmaking এর এমন একটি পদ্ধতি,  যা বাস্তব এবং ডিজিটাল জগৎকে একত্রিত করে। মূলতো এই পদ্ধতিতে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজেরি (CGI)  এবং ভিজুয়াল ইফেক্টকে রিয়েল টাইমে একত্রিত করে, বাস্তব এবং অবাস্তব জগৎ এর মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনে। 

ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের মূল উপাদান সমূহ: 

 এই পর্যায়ে ভার্চুয়াল প্রোডাকশনে জন্য ব্যবহৃত  উপাদান সমূহের  মধ্যে অন্যতম কয়েকটি উপাদান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক।

1. LED Walls
2. Real Time Game Engine 
3. Motion Capture System 
4. Virtual Camera
5. Tracking System 
6. Virtual Production Software 
7. High-performance Computing 

উপাদান সমূহের বর্ণনা:

১/ LED Walls: ভার্চুয়াল প্রোডাকশনে সব থেকে বেশি যেটি চোখে পরে তা হলো এই LED Wall।  মূলত অভিনেতার আসেপাশের জায়গা টুকো রাউন্ড সেপে অত্যাধুনিক LED Display দ্বারা তৈরি করা হয়। এই LED  Wall গুলো মূলতো উচ্চ মাত্রার গেমিংয়ের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা, যার ফলে এর রেজুলেশন সাধারণ LED Display'r তুলনায় অনেক বেশি। LED Wall ব্যবহারের সুবিধা গুলো হচ্ছে, এর মাধ্যমে বাস্তব-সম্মত আলো পাওয়া যায়, প্রয়োজন অনুসারে দ্রুত পরিবেশের পরিবর্তন করা যায়। 

২/ Real Time Game Engine: Unreal Engine এই ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, এই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তিটি ব্যবহারের ফলে অবিশ্বাস সব কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলো:

• উচ্চ মানের 3D পরিবেশ রিয়েল টাইম-রেন্ডারিং।
• প্রয়োজন এবং ক্যামেরা অনুসারে গতিশীল আলো উৎপন্ন করা। 
• প্রয়োজন অনুসারে এডিটিং করার সুযোগ।
• অন্যান্য সব ভার্চুয়াল ডিভাইসের সাথে একীকরণ। 

৩/ Motion Capture System:  এই পদ্ধতির মাধ্যমে অভিনেতার প্রতিটি মোশন নিখুত ভাবে ধারন করা হয়। এবং এর মাধ্যমে রিয়েল-টাইমে অভিনেতার গতিবিধিকে প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করাও সম্ভব। 

৪/ Virtual Cameras: ভার্চুয়াল ক্যামেরার মাধ্যমে বড় কোনো একটি ক্লিপের মধ্যে অবস্থিতো ছোট কোনো অংশকেও আলাদা ভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। মূলত গেম ইঞ্জিনের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারার জন্যই এটি করা সম্ভব হয়।

৫/ Tracking Systems: এই অংশটি মূলত ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল জগৎ এবং বাস্তব জগৎকে রিয়েলটাইমে একত্রিত করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে,  এর মধ্যে রয়েছে অবজেক্ট ট্র্যাকিং, লেন্স ট্র্যাকিং এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি গুলো।

৬/ Virtual production Software: এই সকল জটিল বিষয় গুলো পরিচালনা এবং পর্যালোচনার জন্য বিশেষ Software ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলো, Previsualization Tools, Colour Management Software, Virtual Scouting Applications ইত্যাদি। 

৭/ High-performance Computing: উচ্চ মাত্রার এই কাজ গুলোর জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার সিস্টেম  প্রয়োজন।  বিশেষ করে, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন GPU, কম লেটেন্সির নেটওয়ার্ক এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টোরেজ এর সুবিধা।

উপরোক্ত সকল প্রযুক্তির সংমিশ্রণের মাধ্যমে ভার্চুয়াল প্রোডাকশন সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রতিটি কম্পোনেন্টই এই কাজে বিশেষ ভাবে ভূমিকা পালন করে।

ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের সুবিধা সমূহ :

ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের অনেক গুলো সুবিধার মধ্যে অন্যতম সুবিধা গুলো হলো, 

১/ ভ্রমন, পরিবহন ইত্যাদির প্রভাব কমিয়ে আনে।

২/ সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া যায়।

৩/ কম সময়ে চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়া যায়।

৪/ দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবহার করলে, খরচ কমিয়ে আনে।

৫/ সৃজনশীলতা প্রকাশের ব্যাপক সুযোগ প্রদান করা।

মূলত উক্ত কারণ গুলো বিশেষ ভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আকৃষ্ট করছে এবং প্রতি নিয়তো ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে।

Case Study: The Mandalorian 

বিগত বছরগুলোতে সফল ভাবে ভার্চুয়াল প্রোডাকশনের ব্যবহারের সব থেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে, ডিজনি+ এর সিরিজ " দ্য ম্যান্ডালোরিয়ান। শো-টির প্রযোজনা টিম প্রয়োজন অনুসারে, রিয়েল টাইম রেন্ডারিং, ক্যামেরা ট্রেকিং এবং ভার্চুয়াল সেট এক্সটেনশনের সাথে "দ্য ভলিউম" নামের একটি অত্যাধুনিক ২০ ফুট উচ্চতার কার্ভন LED  Wall ব্যবহার করছে।

Conclusion:

ফিল্মমেকিং এর জগতে দীর্ঘ দিন কোনো বিপ্লব ঘটেনি, ভার্চুয়াল প্রোডাকশন নতুন ভাবে বিপ্লব ঘটাবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত কম সময়ে অধিক কাজ করতে পারার সুবিধাটি সবাইকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে। তার পাশাপাশি অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ব্যবহার কাজকে সহজ করে তুলছে পাশাপাশি সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বাস্তবে রূপান্তর করার পথ খুলে দিচ্ছে নতুন করে।

FAQs:

ভার্চুয়াল প্রোডাকশন এবং ট্রেডিশনাল গ্রিন স্ক্রিনের মধ্যে মূল পার্থক্য কী?

ভার্চুয়াল প্রোডাকশনে, অভিনেতারা একটি ভার্চুয়াল সেটের মধ্যে অভিনয় করে, যা রিয়েল টাইমে একটি LED ওয়ালে প্রদর্শিত হয়। এটি অভিনেতাদের জন্য আরও ইমারসিভ এবং বাস্তবসম্মত একটি অভিজ্ঞতা প্রদান করে। অন্যদিকে, ট্রেডিশনাল গ্রিন স্ক্রিনে, অভিনেতারা একটি সবুজ পর্দার সামনে অভিনয় করে এবং ভিজুয়াল ইফেক্ট পরে যোগ করা হয়। ভার্চুয়াল প্রোডাকশন রিয়েল টাইমে ফিডব্যাক দেয় এবং পরিবর্তন করার সুযোগ দেয়, যা ট্রেডিশনাল গ্রিন স্ক্রিনের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

ভার্চুয়াল প্রোডাকশন, কীভাবে চলচ্চিত্র তৈরির খরচ কমাতে সাহায্য করে?

ভার্চুয়াল প্রোডাকশন অনেকগুলি উপায়ে চলচ্চিত্র তৈরির খরচ কমাতে সাহায্য করে। এর মধ্যে রয়েছে: 

• লোকেশনে শুটিংয়ের খরচ কমায়: ভার্চুয়াল সেট ব্যবহার করে, দূরবর্তী বা কল্পনার লোকেশনে শুটিংয়ের খরচ কমায়। 
• পরিবহন এবং লজিস্টিক্স খরচ কমায়: সবকিছু একটি স্টুডিওতে করা যায়, যার ফলে পরিবহন এবং লজিস্টিক্স খরচ কমে যায়। 
• পোস্ট-প্রোডাকশন সময় এবং খরচ কমায়: রিয়েল টাইমে ফিডব্যাকের কারণে পোস্ট-প্রোডাকশনে কম সময় এবং খরচ হয়।

ভার্চুয়াল প্রোডাকশন কি শুধু বড় বাজেটের ছবির জন্যই?

না, আগে ভার্চুয়াল প্রোডাকশন শুধু বড় বাজেটের ছবির জন্যই ব্যবহৃত হত। কিন্তু প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে এটি এখন আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। মধ্যম এবং ছোট বাজেটের ছবিও এখন ভার্চুয়াল প্রোডাকশন ব্যবহার করছে।